চাটমোহরে মাছ ধরার অন্যতম উপকরণ খৈলশুনি বেচাকেনা জমে উঠেছে।
|
![]() মোঃ আব্দুল আজিজ,পাবনা প্রতিনিধি বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় জমে উঠেছে চাটমোহরসহ চলনবিল অঞ্চলের মাছ ধরার অন্যতম উপকরণ খৈলশুনির (কোথাও নাম চাই) হাটগুলো। চাটমোহরের সর্ববৃহৎ অমৃতকুন্ডা হাট (রেলবাজার হাট) ঘুরে রবিবার (৯ আগস্ট) দেখা যায়, করোনার প্রভাবে হাটে লোক সমাগম কম হলেও কেনাবেচা বেশ ভালই চলছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ হাটে খৈলশুনি কেনাবেচা হয়। এ ছাড়া, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ হাট, গুল্টা হাট, রায়গঞ্জের নিমগাছীর হাট, সলঙ্গা হাট, চাটমোহরের ছাইকোলা হাট, মির্জাপুর হাট, নাটোরের গুরুদাসপুর হাট, চাচকৈড় হাটসহ চলনবিল অঞ্চলের অন্যান্য হাটেও খৈলশুনি পাইকারি ও খুচরা বেচাকেনা হয়। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পাইকাররা এসব হাটে এসে খৈলশুনি কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। তবে খৈলশুনি পরিবহনের সময় আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়কে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা দিতে হয় বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক। বর্ষায় ক্ষেতে কাজ না থাকায় চলনবিল অঞ্চলের অভাবী হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য মাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত হন। তাই বর্ষায় খৈলশুনির কদরও বেড়ে যায়। মাছ ধরার এ উপকরণ তৈরির কাজ সারা বছর চললেও প্রতি বছর এ সময় খৈলশুনি তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। জৈষ্ঠের শেষ থেকে খৈলশুনির পূর্ণ মৌসুম শুরু হয়ে যায়। বাঁশ, তালের আঁশ আর লই দিয়ে তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র খৈলশুনি তৈরি করে এখন স্বাচ্ছন্দে জীবন কাটাচ্ছেন চলনবিল এলাকার চাটমোহর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, তাড়াশ, সিংড়াসহ এর আশপাশ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। আর এ যন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ধরে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছেন হাজার হাজার মৎস্যজীবী। চলনবিল এলাকায় বংশানুক্রমে খৈলশুনি তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত সবাই। চাটমোহরের ধরইল মৎস্যজীবী পাড়ার রফিক জানান, খৈলশুনি তৈরি তার পৈত্রিক পেশা। স্ত্রী ও দুই সন্তানের সহায়তায় সপ্তাহে তিনি ছয়-সাতটি খৈলশুনি তৈরি করতে পারেন। তার পাড়ার ৪শ পরিবারের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩শ পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত। তিনি আরও জানান, নিজের জমাজমি নাই। খৈলশুনি তৈরি করে দিনাতিপাত করছি। অন্যের বাড়িতে কাজে যেতে হচ্ছে না। আকার ভেদে খৈলশুনির দামে রয়েছে অনেক তারতম্য। ৪শ থেকে ২ হাজার টাকা জোড়া পর্যন্ত বিক্রি হয় খৈলশুনি। প্রতি জোড়ায় তাদের ১শ টাকার মতো লাভ থাকে। বড়াইগ্রামের রানীর হাটের শহিদুল ইসলাম (৪৭) জানান, প্রথমে বাঁশ চিরে খিল তোলা হয়। সেগুলো শুকিয়ে নেওয়া হয় হালকা রোদে। পঁচানো তালের ডাগুরের আঁশ দিয়ে বাঁশের খিল বান দেওয়া হয়। এসব কাজে গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরাও পরিবারকে সহায়তা করে থাকে। চলন বিলাঞ্চলের ধারাবারিষা, উদবাড়িয়া, সিথুলী, তালবাড়িয়া, সিরামপুর, দারিকুশি, চন্ডিপুর, সোনাবাজুসহ বিভিন্ন গ্রামে এখন দিন-রাত চলছে খৈলশুনি তৈরির কাজ। তিনি আরও জানান, গত ১৫ বছর যাবত এ পেশায় সম্পৃক্ত আছেন। প্রতি জোড়া খৈলশুনি চার থেকে পাঁচ’শ টাকায় বিক্রি হয়। দাড়িকুশী গ্রামের আব্দুল মতিন বলেন,আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলে বাড়ির এ তিনজন খৈলশুনি তৈরি করি। সপ্তাহে দশ-বারোটি খৈলশুনি তৈরি করতে পারি। নিজে তৈরির পাশাপাশি শীতের সময় যখন দাম কম থাকে তখন খৈলশুনি কিনে রাখি। এসময়ে বিক্রি করি। পাবনার বিভিন্ন এলাকাসহ সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ঢাকার ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যায় এগুলো। সব মিলিয়ে এতে আমাদের সংসার চলে যায়। বাঁশ নির্ভর এ শিল্পে সম্পৃক্ত হয়ে উৎপাদনকারী, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, ব্যবহারকারীরাসহ সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। ছোট মাছের চাহিদার একটা বিরাট অংশ মেটাচ্ছে এ শিল্প। তবে ক্রেতারা অভিযোগ করেন চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাটসহ অধিকাংশ হাটে প্রতিটি খৈলশুনির জন্য ২০ টাকা খাজনা আদায় করেন ইজারাদার, যা অত্যন্ত অযৌক্তিক। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মমাফিক খাজনা আদায় করার দাবি জানিয়েছেন ক্রেতারা।
|